শিশুরা কেন নিয়মিত টিকা গ্রহণ করা জরুরি?

🧒 শিশুর টিকা – স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল চাবিকাঠি
প্রতিটি শিশুর সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে শুরুটা করতে হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিয়ে। আর সেই স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রথম ধাপই হলো শিশুর টিকা। জন্মের পর শিশুদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব দুর্বল থাকে। ফলে তারা নানা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। তাই সময়মতো টিকা প্রদান শিশুর জীবনে সুস্থতার বীজ বপন করে।
💉 শিশুর টিকা: কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
টিকাদান হলো একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। সাধারণত, টিকা তৈরি হয় জীবাণুর দুর্বল বা নিষ্ক্রিয় সংস্করণ থেকে, যা শরীরে প্রবেশ করার পর ইমিউন সিস্টেমকে প্রশিক্ষিত করে দেয়।
✅ শিশুর টিকা কীভাবে কাজ করে?
প্রথমত, টিকা ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হয়।
এরপর শরীর সেটিকে হালকা আক্রমণ হিসেবে দেখে এবং প্রতিক্রিয়া জানায়।
এর ফলে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যা ভবিষ্যতে সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
ভবিষ্যতে একই জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলে শরীর তা দ্রুত প্রতিহত করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ:
বিসিজি টিকা যক্ষ্মা থেকে রক্ষা করে।
পোলিও টিকা শিশুকে পঙ্গুত্বের হাত থেকে বাঁচায়।
হেপাটাইটিস বি টিকা লিভারের মারাত্মক রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
🛡️ শিশুর টিকা কেন প্রয়োজন?
শিশুর টিকা শিশুদের শুধুই একটি নির্দিষ্ট রোগ থেকে রক্ষা করে না, বরং এটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করে।
✅ শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়।
✅ দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগের সম্ভাবনা কমে যায়।
✅ চিকিৎসা খরচ কমে, ফলে পরিবার অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়।
✅ সমাজে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়, যার ফলে অন্যরাও নিরাপদ থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, টিকাদান ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতি বছর ২০–৩০ লক্ষ মৃত্যুর ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
🗓️ শিশুর টিকা সময়সূচি (EPI অনুযায়ী)
বয়স | টিকার নাম | রোগ | ডোজ |
---|---|---|---|
জন্ম | বিসিজি, হেপাটাইটিস বি | যক্ষ্মা, হেপাটাইটিস বি | ১ |
৬ সপ্তাহ | পেন্টাভ্যালেন্ট, পোলিও | ডিপথেরিয়া, হেপাটাইটিস বি | ১ |
১০ সপ্তাহ | পেন্টাভ্যালেন্ট, পোলিও | পূর্বের মতো | ২ |
১৪ সপ্তাহ | পেন্টাভ্যালেন্ট, পোলিও | পূর্বের মতো | ৩ |
৯ মাস | এমআর (হাম-রুবেলা) | হাম, রুবেলা | ১ |
১৫ মাস | এমআর বুস্টার | পূর্বের টিকার বুস্টার | ১ |
📌 এই টিকাগুলো বাংলাদেশ সরকারের EPI প্রোগ্রামের আওতায় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
🌍 বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও UNICEF-এর দৃষ্টিকোণ
🔗 WHO: Immunization Coverage
প্রতি বছর টিকার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ শিশু রক্ষা পায় মারাত্মক সংক্রমণ থেকে।
WHO ও UNICEF-এর মতে, টিকাদান না করলে শিশুমৃত্যুর হার ৮০% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
উন্নত দেশগুলোর ৯৫% শিশু টিকাদান সম্পন্ন করে। উন্নয়নশীল দেশেও এই হার বাড়ানো জরুরি।
🧾 শিশুর টিকা বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতনতা
শিশুর টিকা নিশ্চিত করতে অভিভাবকদের:
✅ সময়মতো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে উপস্থিত থাকতে হবে।
✅ টিকাদান কার্ডে প্রতিটি ডোজ লিখে রাখতে হবে।
✅ প্রয়োজনে মোবাইলে রিমাইন্ডার সেট করা যেতে পারে।
🔚 উপসংহার
শেষ কথা হলো, শিশুর টিকা শুধু একটি স্বাস্থ্যকর অভ্যাস নয়—এটি একটি সামাজিক দায়িত্ব। কারণ, আজকের একটি টিকা আগামী দিনের একটি জীবন বাঁচাতে পারে। তাই আর দেরি না করে, শিশুর টিকা সময়মতো সম্পন্ন করুন।
🔗 আরও পড়ুন: শিশুদের স্বাস্থ্যরক্ষা: শুরু থেকে সঠিক যত্নের টিপস

🧠 শিশুর টিকা নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা ও সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা
যদিও সরকার ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো টিকা নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে, তথাপি আমাদের সমাজে এখনও কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা রয়ে গেছে। এই ভুল ধারণাগুলো অভিভাবকদের টিকাদান বিষয়ে দ্বিধায় ফেলতে পারে এবং শিশুর স্বাস্থ্যকে ঝুঁকিতে ফেলে। ফলে, সঠিক তথ্য এবং যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যার ভিত্তিতে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
❌ টিকা নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা
🔴 “টিকা দিলে শিশুর জ্বর হয়, তাই না দিলেই ভালো” ➡️ বাস্তবতা হলো, হ্যাঁ—টিকা নেওয়ার পর সামান্য জ্বর হতে পারে, তবে এটি শরীরের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, যা প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির একটি চিহ্ন।
🔴 “প্রাকৃতিকভাবে রোগ হলে ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয়” ➡️ এই যুক্তি বিপজ্জনক। অনেক সংক্রমণ শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে, যা প্রতিরোধযোগ্য টিকার মাধ্যমে সহজেই এড়ানো সম্ভব।
🔴 “টিকা অনিরাপদ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে” ➡️ প্রতিটি টিকা বহু গবেষণা, ট্রায়াল এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায়। স্বল্পমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন জ্বর বা ব্যথা থাকলেও এর উপকার বহুগুণ বেশি।
👪 অভিভাবকদের ভূমিকা ও সচেতনতা
যেহেতু শিশুর পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়, তাই অভিভাবকদের সচেতন ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
✅ প্রতিটি টিকার নির্ধারিত সময় সম্পর্কে জানতে হবে। ✅ টিকাদান কার্ড সংরক্ষণ এবং প্রতিটি ডোজের সময়মতো প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। ✅ প্রয়োজনে মোবাইল রিমাইন্ডার বা স্থানীয় স্বাস্থ্য সহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে।
🌐 আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং UNICEF-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী:
প্রতি বছর প্রায় ৪০ লক্ষ শিশু শুধুমাত্র প্রতিরোধযোগ্য রোগে মারা যায়।
এই মৃত্যুর ৮০% সঠিক টিকাদানের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
উন্নত দেশগুলোতে টিকাদান হার ৯৫% এরও বেশি, যেখানে উন্নয়নশীল দেশে এটি এখনও কম।
🔗 UNICEF: Child Immunization Programs
🔬 শিশুর টিকার বৈজ্ঞানিক কার্যকারিতা
টিকা শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে।
ইমিউন সিস্টেম ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে শেখে।
টিকা নেওয়া শিশু শুধু নিজে নিরাপদ থাকে না, বরং সমাজে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করে অন্যদেরও রক্ষা করে।
COVID-19 মহামারির সময় টিকার গুরুত্ব নতুন করে বোঝা গেছে।
📝 সারসংক্ষেপ
অভিভাবকদের টিকা নিয়ে ভয় বা ভুল ধারণা না রেখে সচেতনতার মাধ্যমে সময়মতো শিশুর টিকা নিশ্চিত করা জরুরি। সঠিক তথ্য জানলে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয় এবং শিশুর ভবিষ্যৎ নিরাপদ হয়। তাই, এখনই সময় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার।
🔗 আরও পড়ুন:

🌱 স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ গঠনে শিশুর টিকা ও পুষ্টির সমন্বয়
শুধু টিকা দিলেই শিশু পুরোপুরি সুরক্ষিত নয়। তার শরীরকে টিকার কার্যকারিতা বজায় রাখতে সহায়তা করতে হবে সঠিক পুষ্টি ও স্বাস্থ্য-পরিচর্যার মাধ্যমে। তাই শিশুর টিকা এবং পুষ্টি—এই দুটি বিষয় পরস্পরের পরিপূরক।
💪 শিশুর টিকা: সুস্থ ভবিষ্যতের ভিত্তি
একটি শিশু সময়মতো টিকা গ্রহণ করলে:
তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ যথাযথভাবে হয়।
সংক্রমণজনিত রোগ থেকে রক্ষা পায়, যার ফলে স্কুল বা খেলাধুলায় অনুপস্থিতির হার কমে।
শারীরিক গঠন ও মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্য স্বাভাবিক গতিতে বিকশিত হয়।
টিকা প্রদান শিশুর স্বাস্থ্যসচেতন ভবিষ্যতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়, যেখানে সে নিজে সুস্থ থেকে সমাজের জন্যও উপকারী হয়ে ওঠে।
🍎 শিশুর পুষ্টির গুরুত্ব
টিকাদান শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে, তবে সেটি বজায় রাখতে প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার।
🥦 সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, দুধ ও ডিম শিশুর ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
🥗 ভিটামিন A, C ও D এবং আয়রন শিশুর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
💧 পর্যাপ্ত পানি পান এবং পরিমিত বিশ্রাম ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় রাখে।
🔗 আরও পড়ুন:
📋 অভিভাবকদের করণীয়
✅ শিশুর সুষম খাদ্য তালিকা তৈরি করুন। ✅ বয়স অনুযায়ী পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন। ✅ নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ✅ টিকার সময়সূচি মেনে চলুন এবং কার্ড আপডেট রাখুন। ✅ প্রয়োজনে ঘরোয়া চিকিৎসার মাধ্যমে সাময়িক উপসর্গে ব্যবস্থা নিন।
🔗 ঘরোয়া চিকিৎসায় দ্রুত আরাম পাবেন যেভাবে
🧭 স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতা
✅ স্কুল ও কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রোগ্রাম আয়োজন করুন। ✅ স্বাস্থ্য সহকারীর পরামর্শে অংশ নিন। ✅ স্থানীয় ক্লিনিক বা হাসপাতাল থেকে টিকা ও পুষ্টি বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করুন।
🏁 উপসংহার
পরিশেষে, শিশুর টিকা এবং পুষ্টি মিলেই একটি শিশু সুস্থ, বুদ্ধিমান ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। অভিভাবক হিসেবে আপনার দায়িত্ব শুধু টিকা দেওয়ায় সীমাবদ্ধ নয়—বরং সেই টিকার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যকর খাবার, পরিচ্ছন্নতা ও নিয়মিত যত্ন বজায় রাখা।
টিকা ও পুষ্টির সমন্বয়ই পারে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ ও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে।
🔗 আরও পড়ুন: